ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর অবস্থান ও প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী তা আলোচনা করো ।

মাধ্যমিক দশম টেন ভূগোল madhyamik class 10 x geography questions answers প্রশ্নোত্তর ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর অবস্থান ও প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী তা আলোচনা করো krantiyo mousumi jolobayur abosthan o prodhan boishistoguli ki ki ta alochona koro


উত্তর :  ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি ( 1883 ) সর্বপ্রথম ‘মৌসুমি ’ শব্দটি ব্যবহার করেন । এটি আরবি শব্দ ‘ মৌসিন ’ বা মালয় শব্দ ‘ মনসিন ' থেকে উদ্ভূত যার অর্থ ‘ ঋতু’ । উভয় গোলার্ধে 10 °-25 ° অক্ষাংশ বিশিষ্ট অঞ্চলে বছরের অধিকাংশ সময়ে ঋতু অনুসারে বিপরীতমুখী মৌসুমি বায়ু দ্বারা প্রভাবিত ঋতুভিত্তিক পরিবর্তনশীল অঞ্চলকে মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চল বলে । মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যগুলি হল - 

(১) ঋতু পরিবর্তন : মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে সারাবছর ধরে উষ্ণতার হ্রাসবৃদ্ধি বা পরিবর্তন লক্ষ করা যায় । উষ্ণতার এই পরিবর্তন অনুসারে এবং মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের আগমন ও প্রত্যাবর্তন অনুসারে এই জলবায়ু অঞ্চলে চারটি ঋতু পর্যায়ক্রমে আবর্তন করে । এই চারটি ঋতু হল –  ( i ) উষ্ণ আর্দ্র গ্রীষ্মকাল : দক্ষিণ - পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন পূর্ব সময়কাল ( মার্চ থেকে জুন ) ।

( ii ) আর্দ্র বর্ষাকাল : দক্ষিণ - পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন কাল ( জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর )। 

( iii ) স্বল্পস্থায়ী শরৎকাল : দক্ষিণ- পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাবর্তন কাল ( অক্টোবর থেকে নভেম্বর ) । 

( iv ) শীতল ও শুষ্ক শীতকাল : উত্তর - পূর্ব মৌসুমি বায়ুর আগমনকাল ( ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি)।অর্থাৎ ঋতু পরিবর্তন মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য একটি বৈশিষ্ট্য । 


(২) উষ্ণতা - সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য : ( i ) বর্ষব্যাপী উচ্চ উষ্ণতা : এই জলবায়ু অঞ্চলে সারাবছরই উচ্চ উষ্ণতা বিরাজ করে , তবে সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নের সঙ্গে উষ্ণতার লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায় । 

( ii ) গ্রীষ্মে অধিক উষ্ণতা : গ্রীষ্মকালীন মাসগুলির গড় উষ্ণতা 27 °C 32 ° C হলেও এপ্রিল - মে মাসে এখানে সর্বোচ্চ উষ্ণতা পাওয়া যায় প্রায় 38° C- 48 °C হয় । 

( iii ) শীতকালীন উষ্ণতা : শীতকালীন মাসগুলিতে দিনের বেলায় গড় উষ্ণতা থাকে 10 °C - 27 °C পর্যন্ত । নিম্ন অক্ষাংশে উষ্ণতা বেশি এবং উচ্চ অক্ষাংশে উষ্ণতা কম থাকে । এ ছাড়া , সমুদ্র উপকূল থেকে দূরে উষ্ণতা ক্রমশ হ্রাস পায় ।  


(৩) বায়ুচাপ ও বায়ুপ্রবাহ সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য :   ( i ) বায়ুচাপীয় ঢালের পরিবর্তন : সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিনায়নের সঙ্গে গ্রীষ্ম ও শীতকালে বায়ুচাপের ঢাল এবং উচ্চ ও নিম্নচাপ কেন্দ্রের পরিবর্তন ঘটে । 

 

( ii ) গ্রীষ্মকালীন নিম্নচাপ কেন্দ্রের অবস্থান : গ্রীষ্মকালে লম্ব সূর্যরশ্মির জন্য দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের স্থলভাগে গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্র ( 999-1008 মিলিবার ) এবং ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত  মহাসাগরে উচ্চচাপ অঞ্চল সৃষ্টি হয় ।


( iv ) উষ্ণতার বার্ষিক প্রসর : এই অঞ্চলের বার্ষিক উষ্ণতার প্রসর 2 °C - প্রায় 12°C পর্যন্ত হয় । এবং উষ্ণতার এই প্রসর সমুদ্র থেকে দূরত্ব , মহাদেশীয় অবস্থান , অক্ষাংশগত অবস্থান , সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রভৃতি বিষয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । 

( v ) উষ্ণতার দৈনিক প্রসর : (a) এই জলবায়ু অঞ্চলে দৈনিক উষ্ণতার প্রসর গ্রীষ্মকালীন মাসগুলিতে বছরের অন্যান্য ঋতুর মাসগুলির তুলনায় বেশি হয় । যেমন - ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমিতে গ্রীষ্মকালে দিনের বেলা উষ্ণতার প্রায় 44 ° C - 48 °C হয় এবং এই সময় রাত্রিকালে উষ্ণতা থাকে 20 °C - 25 °C । সুতরাং দৈনিক উষ্ণতার প্রসর প্রায় 23 ° C-24 °C পর্যন্ত ওঠে ।

( b) মৃদু শীতল শুষ্কঋতুতে দিনের বেলায় সর্বোচ্চ উষ্ণতা 27 °C - 32 ° C পর্যন্ত ওঠে । এই সময় বায়ুতে আর্দ্রতা কম থাকায় এই উত্তাপ অসহনীয় বোধ হয় না । 

(c) শুষ্ক বায়ু এবং মেঘমুক্ত আকাশ ভূপৃষ্ঠ থেকে দ্রুত তাপ বিকিরণে সাহায্য করে বলে সাধারণত রাতের বেলায় তাপমাত্রা অনেক সময় 16°C- এর নীচে নেমে যায় ।

(d ) এই জলবায়ু অঞ্চলে দৈনিক তাপমাত্রার প্রসর অঞ্চল ভেদে পরিবর্তিত হয় । যেমন , মুম্বাই ও চেন্নাই শহরের দৈনিক তাপমাত্রার প্রসর যথাক্রমে 8.3 °C এবং 11° C । কিন্তু সমুদ্র থেকে অভ্যন্তরে অবস্থিত বিভিন্ন স্থানে দৈনিক তাপমাত্রার প্রসর প্রায় 16 ° C হয় । 

 

(iii) শীতকালীন উচ্চচাপ কেন্দ্রের অবস্থান : শীতকালে বায়ুচাপের বণ্টন সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যায় । সূর্যের তির্যক রশ্মির প্রভাবে এশিয়ার স্থলভাগে উচ্চচাপ কেন্দ্র ( 1014-1026 মিলিবার ) এবং দক্ষিণের মহাসাগরে নিম্নচাপ অঞ্চল সৃষ্টি হয় ।

(iv) মৌসুমি বায়ুর প্রাধান্য : এই জলবায়ু অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ দ্বারা প্রভাবিত হয় । গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ - পশ্চিম দিক থেকে মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় এবং শীতকালে উত্তর - পূর্বদিক থেকে মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় ।



( v ) দুর্বল ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের আগমন : বর্ষাকালে দক্ষিণ - পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রবাহকালে নিকটস্থ সমুদ্রে দুর্বল ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত বা ডিপ্রেসনের আবির্ভাব ঘটে । শরৎকালে দক্ষিণ - পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাবর্তনকালে শুষ্ক স্থলবায়ু ও শুষ্ক সমুদ্রবায়ুর সংঘর্ষে উপকূল অঞ্চলে শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের আবির্ভাব ঘটে । যথা — সাইক্লোন , টাইফুন , হ্যারিকেন প্রভৃতি । 

( vi ) পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রাদুর্ভাব : শীতকালে ভূমধ্যসাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্পপূর্ণ পশ্চিমাবায়ুর প্রভাবে উত্তর ভারতে পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রাদুর্ভাব ঘটে । 

( vi ) ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি : গ্রীষ্মকালে সারাদিনের প্রচণ্ড উত্তাপে অপরাহ্নে স্থানীয়ভাবে হঠাৎ ক্ষণস্থায়ী ক্ষুদ্র নিম্নচাপ কেন্দ্র গড়ে ওঠে । ফলে প্রবল বজ্রবিদ্যুৎসহ শিলাবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় । এটি পশ্চিমবঙ্গ , বাংলাদেশ ,ওড়িশাতে ‘ কালবৈশাখী ’, দক্ষিণ ভারতে ‘ আম্রবৃষ্টি’,পশ্চিম ভারতে ‘ আঁধি ’এবং অসমে ‘ বরদইছিলা ’নামে পরিচিত । 


(৪) বৃষ্টিপাত সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য : ( i ) বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি : মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে সাধারণত ঘূর্ণবাতজনিত বৃষ্টিপাত প্রক্রিয়া ও শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে । তবে সামান্য পরিমাণ পরিচলন বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে । 

( ii ) অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত বর্ষাকাল : বর্ষাকালে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে উষ্ণ ও আর্দ্র দক্ষিণ- পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় বলে এর প্রভাবে প্রায় ৪০ % বার্ষিক বৃষ্টিপাত ঘটে । 

( iii ) বন্যাও খরার সৃষ্টি : এই জলবায়ু অঞ্চলে দক্ষিণ - পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর খামখেয়ালিপনার জন্য কোনো বছর অতিবৃষ্টিতে বন্যা, আবার কোনো বছর অনাবৃষ্টিতে খরা সৃষ্টি হয় । 

( iv ) বৃষ্টিপাতের অসমবণ্টন : মৌসুমি বৃষ্টিপাতের বণ্টন সর্বত্র সমান নয় । ভূপ্রকৃতি ও সমুদ্র থেকে দূরত্বের ওপর কোনো স্থানের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নির্ভর করে । 

( v ) সাময়িক বৃষ্টি বিরতি : দক্ষিণ - পশ্চিম মৌসুমি বায়ু থেকে এই অঞ্চলে একটানা বৃষ্টিপাত হয় না । নিম্নচাপ অক্ষের স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাতের সাময়িক বিরতি ঘটে । 

( vi ) বৃষ্টিহীন শীতকাল : শীতকালে এই জলবায়ু অঞ্চলের ওপর দিয়ে শীতল ও শুষ্ক উত্তর - পূর্ব মৌসুমি বায়ুপ্রবাহিত হয় বলে শীতকালে এখানে কোনো বৃষ্টিপাত হয় না । সেইজন্য মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে শীতকালে শীতল ও শুষ্ক জলবায়ু বিরাজ করে । 


(৫) মেঘাচ্ছন্নতা ও আর্দ্রতা : (a) বছরের বিভিন্ন ঋতুতে আকাশে মেঘপুঞ্জের পরিমাণ হ্রাসবৃদ্ধি পায় । বর্ষাকালীন মৌসুমি বায়ু প্রবাহকালে আকাশ ঘন কালো মেঘ দ্বারা 95 % -100 % আবৃত থাকে । গ্রীষ্ম ও শীতকালে আকাশ মেঘমুক্ত ও রোদ ঝলমলে হয় । শীতে পশ্চিমি ঝঞ্ঝার সময় স্থানীয়ভাবে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে । ( b ) পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের জন্য মৌসুমি অঞ্চলে আর্দ্রতা অধিক হয় প্রায় বছরে ৪০ % -90 % । বর্ষাকালে তা সর্বোচ্চ অর্থাৎ 90 % -95 % হয় এবং শীতকালে মাত্র 50 % -60 % হয়ে থাকে । 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন