১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি / চরিত্র আলোচনা করো ।

class 10 x history questions answers প্রশ্নোত্তর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি চরিত্র আলোচনা করো ১৮৫৭ khirstabde mohabidroher prokriti choritro alochona koro


উত্তর : কোম্পানি শাসনাধীন ভারতে ইংরেজ বিরোধী ক্ষোভের চরম বহিঃপ্রকাশ ছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ । ভারতীয়দের নিরিখে এই বিদ্রোহ ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় । কিন্তু এই বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র কীরূপ ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিতর্কের অন্ত নেই । 


( i ) সিপাহিদের বিদ্রোহ : শাসকগোষ্ঠীর হয়ে ভারত সচিব আর্ল স্ট্যানলি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলে প্রথম ঘোষণা করেন । এই মতকে সমর্থন করেন জন লরেন্স , হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় , দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যয়, দাদাভাই নওরোজি প্রমুখ । এঁদের মতে , এই বিদ্রোহ শুরু থেকে শেষপর্যন্ত পরিচালনা করেছিল ভারতীয় সিপাহিরা । তাঁদের মতে , সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ এতে যোগদান করেনি । মধ্যবিত্ত শ্রেণির বেশিরভাগ মানুষও এই বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি । বরং শিখ ও গোরখা সেনারা ইংরেজদের সমর্থন করে । তাই কিশোরীচাঁদ মিত্র এই বিদ্রোহকে একান্তভাবেই সিপাহিদের অভ্যুত্থান বলে দাবি করেছেন । 


( ii ) জাতীয় বিদ্রোহ : সিপাহি বিদ্রোহকে সর্বপ্রথম একটি জাতীয় বিদ্রোহ বলে ঘোষণা করেন ব্রিটিশ সাংসদ ডিসরেলি । এই মতের সমর্থক আলেকজান্ডার ডাফ , জে বি নর্টন , ম্যালেসন প্রমুখ । ঐতিহাসিক শশীভূষণ চৌধুরির মতে , এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় যুদ্ধ । তাঁদের মতে , মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে যেভাবে ভারতের জাতীয় সম্রাট বলে ঘোষণা করা হয়, তা জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সাক্ষ্য বহন করে ।অন্যদিকে উক্ত মতের বিরোধিতা করে ড . জুডিথ ব্রাউন বলেছেন যে , ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কেবল উত্তর ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল । ড .রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে , এই বিদ্রোহের সময় ভারতীয়দের মধ্যে কোনো  জাতীয় চেতনা অনুপ্রবেশ করেনি । ড . সুরেন্দ্রনাথ সেনের গ্রন্থ এইট্রিন ফিফটি সেভেন - এ এই বিদ্রোহ জাতীয় বিদ্রোহ হিসেবে পরিগণিত হয়নি । 
 

( iii ) প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ : ভারতের মহান বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে চিহ্নিত করেছেন । এই মতের সমর্থক ঐতিহাসিক সুশোভন সরকার ,শশীভূষণ চৌধুরি প্রমুখ । কার্ল মার্কসও এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে বিবেচনা করেছেন । যদিও এই মতের বিরোধিতা করেছেন ড . রমেশচন্দ্র মজুমদার । তিনি তাঁর The Sepoy mutiny and the Revolt of 1857 গ্রন্থে সিপাহি বিদ্রোহকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বলতে অস্বীকার করেছেন । তবে এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে , সিপাহি বিদ্রোহ গোটা ভারতে বিস্তারলাভ করেনি । এই বিদ্রোহে ভারতের সর্বস্তরের মানুষও অংশগ্রহণ করেনি । এই বিদ্রোহে না -ছিল জাতীয় চেতনা , না - ছিল কোনো জাতীয় নেতা বা স্বাধীনতার মন্ত্র । 


( iv ) সামন্ততান্ত্রিক বিদ্রোহ : আধুনিক কালের বামপন্থী ঐতিহাসিক ড . রজনীপাম দত্তের মতে সিপাহি বিদ্রোহ ছিল একটি সামন্ততান্ত্রিক অভ্যুত্থান । কারণ বিদ্রোহীরা চেয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনের পরিবর্তে মোগল বা মারাঠা সামন্ততান্ত্রিক সাম্রাজ্য । অধ্যাপক সুশোভন সরকার যদিও এই মতের বিরোধিতা করেছেন । তিনি বলেছেন যে , নানাসাহেব , লক্ষ্মীবাঈ , কুনওয়ার সিংহ প্রমূখ সামন্ত জমিদার ও তালুকদারের হাতে বিদ্রোহের নেতৃত্ব ছিল বলে এই বিদ্রোহকে কখনই সামন্তবিদ্রোহ ও প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দেওয়া যায় না ।  


( v ) গণবিদ্রোহের ধারণা : সিপাহি বিদ্রোহকে একটি গণবিদ্রোহ রূপে দাবি করেছেন জে বি নর্টন, ম্যালেসন , উইলিয়াম কে প্রমুখ পণ্ডিত । এই মতের সমর্থক ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র । তাঁর মতে , এই বিদ্রোহে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে যোগ না -দিলে সিপাহিদের অভ্যুত্থান এত গুরুত্ব পেত না । আবার ঐতিহাসিক শশীভূষণ চৌধুরির মতে , এই বিদ্রোহ ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী একটি জাতীয় যুদ্ধ এবং এটি ছিল একটি গণবিদ্রোহ । অতি সম্প্রতি গবেষক ড .রুদ্রাংশু মুখার্জি তাঁর Awadh in 1857 1858 গ্রন্থে এই বিদ্রোহকে একটি সশস্ত্র প্রতিবাদ না - বলে বিদেশি শাসন বর্জনের গণ উদ্যোগ বলে মনে করেন । 


মন্তব্য : পরিশেষে বলা যায় যে , এই বিদ্রোহকে সফল করতে যেভাবে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ভারতের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিল ,তা ছিল একটি গণমুখী আন্দোলনেরই প্রতিচ্ছবি । 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন