উত্তর : পৃথিবীর উভয় গোলার্ধে মহাদেশগুলির পশ্চিম প্রান্তে 30 °- 45° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে শুষ্ক গ্রীষ্ম ও আর্দ্র শীত সম্পন্ন জলবায়ু বিরাজ করে । ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলিতে এই জলবায়ুর বিস্তার ও প্রভাব বেশি বলে একে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু বলে । এই জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যগুলি হল —
(১) উষ্ণতা সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য : ( i ) মৃদুভাবাপন্ন জলবায়ু : ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মৃদুভাবাপন্ন বা সমভাবাপন্ন জলবায়ু । সমুদ্রের তীরে অবস্থিত হওয়ার ফলে এই জলবায়ু অঞ্চলে শীত ও গ্রীষ্মের উষ্ণতা খুব বেশি বা কম হয় না অর্থাৎ শীত ও গ্রীষ্মের তীব্রতা বেশি নয় ।
( ii ) শুষ্ক গ্রীষ্মকাল : এই জলবায়ু অঞ্চলে গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও শুষ্ক । গ্রীষ্মকালে এখানে উষ্ণতা থাকে 21 °C - 27 ° C । সমুদ্র থেকে দূরবর্তী স্থানে 30 ° C- এর বেশি উষ্ণতা লক্ষণীয় ।
( iii ) মৃদু উষ্ণ শীতকাল : এই অঞ্চলে শীতকাল মৃদু উষ্ণ । এই সময় গড়ে উষ্ণতা থাকে 5°C - 1O°C - এর মধ্যে ।
( iv ) বার্ষিক উষ্ণতা প্রসর : ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে বার্ষিক উষ্ণতার প্রসর থাকে 15°C - 17°C- এর মধ্যে । তবে সমুদ্র থেকে মহাদেশের অভ্যন্তরে দূরত্ব যত বাড়তে থাকে বার্ষিক উষ্ণতার প্রসরতা তত বাড়তে থাকে । যেমন — সমুদ্রতীরবর্তী সানফ্রান্সিসকোতে উষ্ণতার প্রসর যেখানে মাত্র 5.5 °C সেখানে সাক্ৰামেনটোতে 15°C , নেপলসে 16°C এবং রোমে 18 ° C ।
( v ) দৈনিক উষ্ণতার প্রসর : ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলের শুষ্কতর স্থানগুলিতে দৈনিক উষ্ণতার প্রসর , বার্ষিক উষ্ণতায় প্রসর অপেক্ষা উচ্চতর । যেমন — আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ উপত্যকায় অবস্থিত সাক্ৰামেনটোতে জুলাই মাসে দিনের বেলা উষ্ণতা থাকে 45.5°C 46°C এবং রাত্রে উষ্ণতা দ্রুত হ্রাস পেয়ে 15.5°C হয় । অর্থাৎ দৈনিক উষ্ণতার প্রসর হয় প্রায় 30°C ।
( vi ) কম উষ্ণতা যুক্ত উপকূলীয় অঞ্চল : গ্রীষ্মকালে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে সমুদ্র থেকে দূরবর্তী স্থানগুলিতে উষ্ণতা তুলনামূলক ভাবে বেশি থাকলেও সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে উষ্ণতা বেশ কম থাকে । উপকূলের সঙ্গে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত কয়েকটি শীতল স্রোত উপকূলবর্তী অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতাকে কমিয়ে দেয় । যেমন — ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের শীতল ক্যালিফোর্নিয়া স্রোত , চিলি অঞ্চলের পেরু স্রোত ও কেপ প্রদেশ অঞ্চলে বেঙ্গুয়েলা স্রোত ।
(২) বায়ুচাপ ও বায়ুপ্রবাহ সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য : ( i ) স্থায়ী ক্রান্তীয় উচ্চচাপ : অঞ্চলটি উভয় গোলার্ধের 30 ° -45 ° অক্ষাংশে অবস্থিত হওয়ায় স্থায়ী ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় বিরাজ করে । এখানে বায়ুচাপ 1020-1026 মিলিবার হয় ।
( ii ) চাপ বলয়ের স্থানান্তর : সূর্যের আপাত বার্ষিক গতির জন্য চাপবলয় ও নিয়ত বায়ুপ্রবাহ বলয় ঋতুভিত্তিক 5° -10 ° স্থান পরিবর্তন করে ।
( iii) বায়ুপ্রবাহের দিক : সূর্যের উত্তরায়ণের ফলে উত্তর গোলার্ধের অঞ্চলটিতে গ্রীষ্মকালে কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয় অবস্থান করে । ফলে এই অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে উত্তর আয়ন - পূর্ব বায়ু এবং দক্ষিণ গোলার্ধে শীতকালে উত্তর - পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয় । আবার সূর্যের দক্ষিণায়নের ফলে উত্তর গোলার্ধের অঞ্চলটিতে শীতকালে সুমেরু বৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় অবস্থান করে । ফলে উত্তর গোলার্ধে শীতকালে পশ্চিমা বায়ু এবং দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকালে আয়ন বায়ু প্রবাহিত হয় ।
( iv ) স্থানীয় বায়ুর প্রাদুর্ভাব : ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে অসংখ্য ভিন্নধর্মী স্থানীয় বায়ুর প্রাদুর্ভাব ঘটে । এই বায়ু বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত । যেমন — আলজিরিয়াতে খামসিন , টিউনিসিয়াতে ।
(৩) মেঘাচ্ছন্নতা ও বৃষ্টিপাত সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য : ( i ) মেঘমুক্ত গ্রীষ্মকাল : বছরের অধিকাংশ সময়ে আকাশ মেঘমুক্ত , নির্মল , নীলাভ এবং আবহাওয়া রোদ ঝলমলে হয় । তবে গ্রীষ্মের তুলনায় শীতকালে আকাশ কিছুটা মেঘলা থাকে ।
( ii ) আর্দ্র শীতকাল : বৃষ্টিবহুল আর্দ্র শীতকাল ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য যা মৌসুমি জলবায়ুর বিপরীত । উত্তর গোলার্ধে ডিসেম্বর - মার্চ এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মে - আগস্ট মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয় ।
( iii ) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ : এই অঞ্চলে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশ কম প্রায় 25-90 সেমি । কারণ উপক্রান্তীয় সংকীর্ণ সমুদ্রে বাষ্পীভবন কম পরিমাণে হয় ।
( iv ) ঘূর্ণাবর্তের আবির্ভাব : শীতকালে 4 মাস দক্ষিণ - পশ্চিম এবং উত্তর - পশ্চিম পশ্চিমাবায়ু ও নাতিশীতোয় মণ্ডলীয় ঘূর্ণবাতের প্রভাবে বার্ষিক বৃষ্টির 75 % হয় ।
( v ) অসম বৃষ্টিপাত : অঞ্চলটিতে বৃষ্টিপাতের বণ্টন অত্যন্ত অসম । নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে , পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে এবং উপকূল থেকে অভ্যন্তরভাগের দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পায় । উপকূল অঞ্চলে উচ্চভূমি বা পর্বত আর্দ্র পশ্চিমাবায়ুকে বাধা দিয়ে প্রতিবাত ঢালে ব্যাপক শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায় । যথা — অ্যাড্রিয়াটিক উপসাগরের ডালমেশিয়ান উচ্চভূমিতে 450 সেমি , দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের টেবিল পর্বতে 200 সেমি ঘিবলি , দক্ষিণ - পূর্ব স্পেন , ইটালি ও উত্তর আফ্রিকাতে সিরোক্কো , স্পেনে লেভেচে , অস্ট্রেলিয়াতে ব্রিক ফিল্ডার প্রভৃতি । আবার শীতকালে ফ্রান্সের রোন উপত্যকায় মিস্ট্রাল, যুগোশ্লাভিয়ার অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলে বোরা , কর্সিকা ও ফ্রান্সে পোনেন্ট প্রভৃতি স্থানীয় বায়ুপ্রবাহিত হয় । আবার অনুবাত ঢালে খুবই কম বৃষ্টিপাত হয় ( সান্তিয়াগোতে 35 সেমি ) ।
( vi ) বছরে দু-বার বর্ষার আগমন : ভূমধ্যসাগরের উত্তর তীরবর্তী উপদ্বীপ ও উপসাগরে বছরে দু- বার শরৎ ও বসন্তে বৃষ্টিপাত হয় ।