বাংলার নবজাগরণে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান কী ছিল ?

মাধ্যমিক দশম টেন ইতিহাস madhyamik class 10 x history questions answers প্রশ্নোত্তর বাংলার নবজাগরণে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান কী ছিল banglar nohojagrone raja rammohon rayer obodan ki chilo


উত্তর : উনিশ শতকে বাংলার ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের ঋত্বিক ছিলেন রাজা রামমোহন রায় । পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি সমকালীন ভারতীয় হিন্দুধর্ম ও সমাজের কুসংস্কারগুলি দূর করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ।  


( i ) ধর্মসংস্কার : ভারতের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান অনস্বীকার্য । উনিশ শতকে ভারতের হিন্দু সমাজ নানান ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল । মূর্তিপূজা , আড়ম্বরপূর্ণ ধর্মীয় আচার - অনুষ্ঠান, বহু দেবতায় বিশ্বাস এসব ছিল হিন্দু ধর্মের অঙ্গ । 


( a ) হিন্দু ধর্মের এই অনাচার দূর করার জন্য যুক্তিবাদী রামমোহন উপনিষদের ব্যাখ্যা দিলেন ।যেখানে একেশ্বর বাদের কথা বলা হয়েছে । তিনি দেখালেন উপনিষদে মূর্তিপূজা বা বহু দেবতার পুজোর কথা বলা নেই । তিনি প্রচার করেন ঈশ্বর এক ও নিরাকার । ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে তুহাফৎ উল মুয়াহিদ্দিন ( একেশ্বরবাদীদের প্রতি) নামে একটি ফারসি পুস্তিকা তিনি প্রকাশ করেন । 

( b ) একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্য তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন । 

( c ) ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্মধর্ম প্রচারের জন্য তিনি গড়ে তোলেন ব্রাহ্ণসভা । ব্রাহ্মধর্মের মূল কথা ছিল পৌত্তলিকতাবাদ ত্যাগ করে নিরাকার ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের উপাসনা । 

( ii ) সমাজসংস্কার : যুক্তিবাদী রাজা রামমোহন রায় হিন্দু সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথাগুলি দূর করার উদ্দেশ্যে সমাজ সংস্কারকরূপে অবতীর্ণ হন । সতীদাহ প্রথা, কন্যাপণ , কোলিন্যপ্রথা দূরীকরণে তিনি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন । 

( a ) সমকালীন হিন্দু সমাজের অভিশাপ ছিল — বহুবিবাহ , বাল্যবিবাহ , কৌলিন্যপ্রথা , সতীদাহপ্রথা , জাতিভেদপ্রথা , অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধি । এই ঘৃণ্য সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায় রুখে দাঁড়ান । সে যুগে হিন্দু সমাজের বহু নারী সহমরণ বা সতীদাহ প্রথার শিকার হত । তিনি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পড়ে প্রমাণ করেন যে , সতীদাহ প্রথা হল একটি ধর্মবিরোধী কাজ । রামমোহন এর জন্য সরকারের কাছে সওয়াল করেন । শেষপর্যন্ত তৎকালীন বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সপ্তদশ বিধি দ্বারা সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন । 

( b ) এ ছাড়া তিনি কন্যাপণ , কৌলিন্যপ্রথা ও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন । 

( c ) সমাজে অবহেলিত নারী জাতির সমানাধিকার ও শিক্ষার জন্য এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহপ্রথা রদের জন্য তিনি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন । 


( iii ) শিক্ষাসংস্কার : তিনি উপলব্ধি করেন , পাশ্চাত্য ভাষা ও শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না - পারলে বহির্জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা যাবে না । এজন্য তিনি তৎকালীন বড়োলাট লর্ড আমহার্স্টকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের জন্য আবেদন জানান । হিন্দু কলেজ ও ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর সহযোগিতা বিশেষভাবে স্মরণীয় । মাতৃভাষার উন্নতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল । গদ্যসাহিত্য রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত । তিনি সম্বাদ কৌমুদী পত্রিকা  প্রকাশ করেন । এ ছাড়া স্ত্রীশিক্ষা প্রসারেও তিনি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন । 


মূল্যায়ন : এতৎসত্বেও এই মানবতাবাদী সমাজসংস্কারক কিন্তু সমালোচনায় বিদ্ধ হন ।অনেকেই ‘বিশ্বপথিক ’ রাজা রামমোহন রায়ের সংস্কার আন্দোলন ও জীবনাদর্শের মধ্যে স্ববিরোধিতা লক্ষ করেছেন । তাঁদের মতে তিনি সব কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে যেতে পারেননি । আবার অনেকের মত যে,হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতাবাদ ও সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি যতটা সরব ছিলেন ,ঠিক ততটাই ম্রিয়মান ছিলেন বহুবিবাহ ও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে । 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন