উত্তর : আঠারো শতকের শেষ দিক থেকে শুরু করে উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ বাংলার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় । এই সময়ের মধ্যে বাংলায় অসংখ্য ছাপাখানা গড়ে ওঠে I
( i ) প্রথম পর্ব : এই সময়ের ( ১৭৭০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ ) মধ্যে বাংলার নানা স্থানে প্রায় ৪০ টি ছাপাখানার সন্ধান পাওয়া যায় । এই তথ্য পাওয়া যায় গ্রাহাম শ - এর রচনা ( Painting in Calcutta to 1800 ) থেকে । এই প্রেসগুলি সাধারণত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ছাপত । এগুলির মধ্যে বেঙ্গল গেজেট , দ্য ইন্ডিয়া গেজেট , দ্য ক্যালকাটা গেজেট ইত্যাদি পত্রিকা ছিল অন্যতম । ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে চার্লস উইলকিস চুঁচুড়ায় প্রথম বাংলা ভাষায় হরফ নির্মাণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন । এর অন্যতম রূপকার ছিলেন পঞ্চানন কর্মকার মহাশয় । ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় একটি প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন ।
( ii ) দ্বিতীয় পর্ব : দ্বিতীয় পর্বে ( ১৮০০-১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ ) বাংলায় ছাপাখানা শিল্পের শ্রীবৃদ্ধি হয় । ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুরে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস গড়ে তোলেন । ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই প্রেস থেকে দু- হাজারের বেশি বই ছাপানো হয় । ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সব বই এখানেই ছাপানো হত । এই প্রেস থেকেই ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে মার্শম্যান দিগ্দর্শন নামক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন । ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতায় অনেক প্রেস স্থাপিত হয় , যেমন —গিলক্রিস্টের হিন্দুস্থানি প্রেস ( ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ ),পার্সিয়ান প্রেস, বাবুরামের সংস্কৃত প্রেস , পটলডাঙ্গার প্রেস , কলুয়াটোলার চন্দ্রিকা প্রেস ইত্যাদি ।
( iii ) তৃতীয় পর্ব : ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব বাংলার ( বর্তমান বাংলাদেশ ) রংপুরে প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় কাটরা প্রেস । ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় বাংলা যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা স্থাপিত হয় । ক্রমে পূর্ববাংলায় অসংখ্য প্রেস স্থাপিত হয় । যেমন — সুলভ যন্ত্র ( ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ ), গিরীশ যন্ত্র ( ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ ) প্রভৃতি।
[ ] আঠারো - উনিশ শতকে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানার হাত ধরে বই প্রকাশনায় যেমন জোয়ার আসে ; তেমনি এদেশে শিক্ষারও যথেষ্ট প্রসার ঘটে । যেমন — ( i ) পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার : এই সময় ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় পাশ্চাত্য শিক্ষার ওপর বই ছাপানো শুরু হয় । সেগুলি পড়ে ভারতীয়রা পাশ্চাত্যের জ্ঞান -বিজ্ঞান, সাহিত্য , ইতিহাস , ভূগোল ও দর্শন সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে ।
( ii ) আধুনিক শিক্ষার প্রসার : পাশ্চাত্যের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ ছাপা বইগুলি পড়ে ভারতীয়দের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা , যুক্তিবাদ ও জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পায় । ফলে এদেশে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটে ।
( iii ) শিক্ষার প্রতি উৎসাহ বৃদ্ধি : ছাপা বই দেখে ও পড়ে শিক্ষার প্রতি ছাত্রদের উৎসাহ বৃদ্ধি পায় । এখন থেকে তারা তাদের প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর পেতে থাকে ।
মন্তব্য : ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি ইউ এন রায় অ্যান্ড সন্স প্রতিষ্ঠা করলে বাংলায় ব্যাবসায়িক ছাপাখানা শিল্পের নবদিগন্ত সূচিত হয় । জেমস লঙ - এর মতে , ১৮৫৯ ( খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় ৪৬ টি প্রেস ছিল । তবে ১৮৮৫-১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সেই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১০৯৪ টি-তে । যদিও ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন ও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের সংবাদপত্র আইন প্রবর্তিত হলে বাংলায় ছাপাখানা শিল্প ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় ।